শাহীন সুলতানা, কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ)
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও রয়েছে জমিদারদের বিভিন্ন রকমের ঐতিহাসিক নিদর্শন যা এখন শুধু স্মৃতি । এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের মধ্যে একটি হচ্ছে জমিদার বাড়ি এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনা ।
স্থানীয়দের মতে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের ছয়সূতী ইউনিয়নের জমিদার প্রথাবনাথ এর স্মৃতি তাঁর নিজ বাড়িটি প্রাচীন পুরাকীর্তির অন্যতম নিদর্শন। ঝঁরাঝির্ণ এই বাড়িটি প্রায় ২শত বছর আগে তৈরি করেছিলেন জমিদার প্রথাব নাথের বাবা। ১শত ২১ শতাংশ ভূমির মধ্যস্থলে প্রতিষ্ঠিত ২শত বছর আগের পুরানো জমিদার বাড়িটি এখন এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন। জমিদার প্রথাব নাথের নিকটাত্মীয়দের সাথে কথা হলে তারা জানান, জমিদার পরিবারের সর্বশেষ জমিদার ছিলেন প্রথাব নাথ।
জমিদার বাড়ির পূর্ব দিকে কালী নদী শাখা বহমান। কালী নদীর ওই শাখার পশ্চিম পাড় ঘেসে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া প্রথাব নাথের বাজার। প্রথাব নাথ নিজেই ২ একর ৫৬ শতাংশ জমির উপর গড়ে তুলেছিলেন এই বাজার। বাজারটি প্রতিষ্ঠা করে সে সময় অনেক সুনাম অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাজারটি আজও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে প্রথাব নাথ বাজার নামে পরিচিত। সপ্তাহে দুই দিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার এখানে হাট বসতো। বাজারটি পাট, বাঁশ ও ধানের জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে বাজারটিতে রয়েছে ছোট ছোট চারটি দোকান আর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশালাকৃতির তিনটি বটগাছ, আমগাছ সহ বেশ কয়েকটি বড় গাছ। বাজারের দক্ষিণ পাশে রয়েছে প্রথাবনাথ বাজার জামে মসজিদ, পূর্বপাশে কালী নদীর শাখা ঘেঁষে পোল্ট্রি মুরগীর ফার্ম, পশ্চিম পাশে পীরে কামেল সৈয়দ মনজুরুল হামিদ শাহ্’র মাজার। বাজারটির সরকারি ইজারা ২২ হাজার টাকা বলে জানা গেছে। বাজারের অস্তিত্ব সংকট দেখা দেওয়ায় কিছু জমি স্থানীয়দের দখলে চলে গেছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের মতে, জমিদার প্রথাব নাথ হল বধু নাথের পুত্র শিব নাথের ছেলে। প্রথাব নাথের দাদা বধুনাথ কখন থেকে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন তা কারোর জানা নেই। তবে শিব নাথের একমাত্র পুত্র ছিলেন জমিদার প্রথাব নাথ। প্রথাব নাথের বাড়টিতে এখন বসবাস করেন তাঁরই বংশধর গিরিশ নাথের উত্তরসূরী।
সরেজমিন প্রথাব নাথের বাড়িতে দাঁড়িয়ে কথা হয় গিরিশ নাথের পুত্রবধু মৃত নরেন্দ্র নাথের বৃদ্ধা স্ত্রী মঞ্জুশ্রী ও তার পুত্র তাপস চন্দ্র দেবনাথের সাথে, তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী জমিদার প্রতাপ নাথের জমির পরিমাণ ছিল ৮৪ ধুন। যা ১৬ কানিতে ১ ধুন হিসেব অনুযায়ী ১৩৩৪ কানি। অর্থাৎ ৪৭৪০ শতাংশ। প্রথাব নাথের সমাধিস্থল কোথায় জানতে চাইলে তারা জানান, জমিদারি প্রথা শেষ হওয়ার পর প্রথাব নাথ নিঃস্ব হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায় কলকাতায়। পরবর্তীতে তিনি দেশে এসে তার শশুর বাড়ি কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চল অষ্টমগ্রামের বাঙ্গালপাড়া গ্রামে পরলোক গমন করেন। বর্তমানে প্রথাব নাথের উত্তরসূরী হিসেবে তাদের কি পরিমান জমি-জমা আছে জানতে চাইলে তারা জানান, শুধু এক একর ২১ শতাংশ বাড়ি আছে। অর্থাৎ মোট ১২১ শতাংশ ভূমি।
জমিদার প্রতাব নাথের কয়টি ভবন ছিল তাও তারা জানেনা তারা। তবে যে ভবনটি এখন দাঁড়িয়ে আছে এর প্লাস্টার খসে পড়েছে, দরজা-জানালা ভেঙে গেছে, কিছু জায়গায় ছাদও ধসে পড়েছে, ছাদের ওপর গাছের জন্ম হয়ে শিকড় ছাদ ও দেওয়াল হয়ে নিচের দিকে আসছে। ভবনের ভিতরে দেখা গেছে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। ভবনের দরজা জানালাও খুলে নিয়ে গেছে।
স্থানীয়রা এই অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে জমিদার প্রথাব নাথের বাড়িটি সংস্কার করার জন্য জেলা প্রশাসক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। একই সাথে প্রথাব নাথ বাজারটি রক্ষার দাবিও করেন তারা। বাজারটির সঙ্গে জমিদার প্রথাব নাথের ইতিহাস লুকায়িত। বাজারটি সংরক্ষণ করাও খুব জরুরি। তা না হলে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে জমিদার প্রথাব নাথের স্মৃতিবিজড়িত ভবন ও প্রথাব নাথ বাজার।